This Article is From Jan 08, 2019

ব্লগ: শীতকাল ও মধ্য কলকাতার অভিমান

ব্লগ: শীতকাল ও  মধ্য কলকাতার অভিমান
কলকাতা:

প্রশ্নটা করেছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম  ধরে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এসেছে বাঙালি। সুপর্ণা না এলেও শীতকাল এসেছে। কিছু দিন আগে পর্যন্ত শীতও আসত কলকাতায়। এখন সবটাই ছায়া।  আবহাওয়া দপ্তরের ইয়া বড় খাতা ঘেঁটে লাভ নেই, এমনিতেই বুঝতে পারা যায় ধীরে ধীরে অতীত হচ্ছে শীতের ধারণা । তবে বঙ্গ সমাজের  চওড়া কপালে ভর করে শীতকাল আজও আসে শহর কলকাতায়। আরও ভাল করে  বললে মধ্য কলকাতায়- ময়দানে, ভিক্টোরিয়ায়, ক্যাথিড্রাল  চার্চে আর হ্যাঁ,  বাঙালির উদরেও শীতকাল আসে। খাদ্যাভাসটা বাদ দিলে নিজেদের সঙ্গে আমরা প্যালারামেরই বেশি মিল পেয়ে  থাকি। প্যালার মতো সেই ভয়ে-ভয়ে থাকা, সেই সুযোগ পেলেই সাহিত্য  করা-  মিল প্রচুর। আর খাওয়ার ব্যাপারেও একটা করে টেনিদা ঘাপটি মেরে বসে আছে সকলের ভেতর। সুযোগ পেলেই  বেরিয়ে পড়ে সে। সেই সুযোগটাই করে দেয় শীতকাল। নাম  বদলের যুগে কোনও এক ভোজন রসিক শীতকালকে উদরপূর্তি কাল নামেও ডাকতে পারেন। গেরুয়া বসন পরিহিত মুখ্যমন্ত্রীর শরণ নেওয়ার প্রয়োজন নেই, সুকুমার রায়ের কথা ভাবলেই যথেষ্ট। তাঁর সৃষ্টির এক বিরাট অংশ জুড়ে ছিল নামকরণ।                         

মধ্য কলকাতার অভিমান না বুঝলে কলকাতায় শীতকালের মাহাত্ম্য বোঝা যাবে না। মধ্য মানে যার অবস্থান মাঝখান। যেমন ধরুন মধ্যবিত্ত। তার বিত্ত আছে আবার নেইও। মানে একদিক থেকে ভাবলে সে রাজা আবার অন্য দিক থেকে কেয়ার অফ ফুটপাথ। এ এক আশ্চর্য ধাঁধা। একই সঙ্গে  আশ্চর্য রকমের অতৃপ্তিও। মধ্য কলকাতাও তাই। বিশেষ করে দক্ষিণ লাগোয়া মধ্য কলকাতার পরতে পরতে আছে অভিমান। বিদেশী শাসনের চিহ্ন আজও স্পষ্ট তার শরীরে। বাঙালির কাছে আজও সে ফিরিঙ্গি, আজও সে ত্যাজ্য! নিস্তব্ধ রাতে কান পাতলে মরে ভূত হয়ে  যাওয়া সাহেবের বুটের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় এখানে। তাই  এলাকার অবস্থান কলকাতার হৃদয়ে হলেও আম বাঙালির হৃদয়ের পাকাপাকি স্থান করে উঠতে পারেনি সে। এবার আসুন উত্তর ঘেষা  মধ্য কলকাতায়- খাস সেন্ট্রাল ‘ক্যালকাটা'। অসংখ্য সরু গলি ওঁত পেতে  রয়েছে সর্বত্র। পাশাপাশি বাস  রাম- রহিমের। দুর্গা পুজো –ইদ- বড়দিন সব মিলে মিশে একাকার। এখানেও ঘাপটি মেরে আছে অভিমান, না পাওয়া, এক ঘরে এক জীবনের কাটানোর অ-সুখ। এ সব নিয়েই চলছে মধ্য  কলকাতা। আমার-আপনার উৎসবে তার প্রবেশ নেই! সারা বছর ব্যস্ত মধ্য কলকাতা নিস্তেজ হয়ে পড়ে পুজোর মরসুমে। সারা বছর চুটিয়ে  ব্যবসা করা পানশালা আর খাবারের দোকানের রোশনাইও যেন কমে যায়। ভিড় এড়াতে  চাওয়া কিছু ছায়া মূর্তির আনাগোনা থাকে শুধু। সব আলো সব রোশনাই যেন বেরিয়ে পড়ে পুজো পরিক্রমায়। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশও ডিউটি করে মহা আনন্দে। মানুষই নেই  তো  নিরাপত্তা  দেবে কাকে? ময়দানের ছবিটা প্রায় একই। গোটা ময়দান চত্বরই যেন বয়স বেড়ে যাওয়া ঘোড়া। জীবনের সেরা সময় পেরিয়েছে। রেসের মাঠ তো কোন ছাড়  ভিক্টোরিয়ায় বেড়াতে আসা লোকেদের বিনোদনের জন্যও তাকে ব্যবহার  করা  চলে না। একা পড়ে থাকে বুড়ো ঘোড়া। একটু জলের জন্য এদিক ওদিক হেদিয়ে মরতে  হয় তাকে। অপেক্ষার মাঝেই একদিন নেমে আসে মৃত্যু। ময়দানেও পুজোর সময় পাক খায় হাহাকার। সর্বত্রই শুধু প্রতীক্ষা। শীতের প্রতীক্ষা। কবে আসবে শীত? কবে সেজে উঠবে ময়দান? ক্যাথিড্রাল চার্চের সামনের রাস্তায় কালো মাথার ভিড় দেখা যাবে কবে? উত্তর খোঁজে কলকাতার ফুসফুস। প্রতীক্ষা যতই দীর্ঘ হোক, শেষ তাকে একদিন হতেই হয়। রকমারি গরম জামার হাতা বেয়ে আসে শীত।

বহুকালের বদনাম বঙ্গ  সমাজ নাকি যুক্তিবোধ নয় প্রবৃত্তিকে বেশি আমল দিয়ে এসেছে। মানে বাড়ির  এ.সি মেশিন বা পাখা  বন্ধ  হবে  কিনা সেটা  ঠিক করে দেয় আলিপুর আবহাওয়া। বঙ্গ ভান্ডারে এমন  রতনও আছে যিনি ডিসেম্বর এলেই শীত এসেছে ধরে  নিয়ে সোয়েটার পরেন। ঠান্ডা লাগলে ভাল আর না  লাগলে সেটা সতর্কতা অবলম্বনের বিজ্ঞাপন। ভাল করে ভাবলে বোঝা যায় কলকাতার শীতও  মধ্যবিত্ত। আর সেটা হয়াঈ  ভাল।           

শীতকাল এলে সব উপেক্ষার জবাব দেয় মধ্য কলকাতা। শহরের সব রাস্তা  তখন গিয়ে মেশে পার্ক স্ট্রিট বা বো ব্যারাকে। প্রতিটি আলোর স্তম্ভে মিশে থাকে দম্ভ আর অপমানের জবাব দেওয়ার তৃপ্তি! পুজোর ক'দিন উত্তর ও মধ্য কলকাতায় থিম জরিপ করা শহর তখন মেতে  ওঠে সেই ‘ ফিরিঙ্গিদের' উৎসবে। 

                                                                 

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                             

.